ভাত খেতে গিয়ে শিশু বড্ড বেশি ঝামেলা করে বলে আপনি বাচ্চাকে টিভি দেখতে দেখতে ভাত খাওয়া অভ্যাস করেছেন। এখন সে আর টিভি না দেখে ভাত খেতেই চায় না। মায়েদের সারাদিন বহু কাজ থাকে। বাচ্চা এটা সেটা বায়না করে কাজের ব্যাঘাত ঘটায়। তাই ভালো উপায় হিসেবে তাকে কার্টুনের চ্যানেল দিয়ে টিভির সামনে বসিয়ে দিলে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। কোন বিরক্ত করে না বলে আপনার কাজের ক্ষেত্রেও সমস্যা হয় না।
কিন্তু জানেন কি এই টিভি দেখা আসলে আপনার সন্তানের জন্য কতখানি ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
শিশুদের খেলার দুটি দিকের কথা এক্ষেত্রে বলা দরকার। কল্পনাপ্রবণ খেলা এবং সৃজনশীল খেলা। কল্পনাপ্রবণ খেলায় শিশুরা ভান করে কে তারা অন্য একটি চরিত্র বা সময়ে আছে। আর সৃজনশীল খেলার ক্ষেত্রে শিশুদের মৌলিক কিছু ধারণা দেখা যায়, যা অন্যদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। অত্যধিক টিভি দেখা এই দুইয়ের উপরেই প্রভাব ফেলে। যদিও এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতের পার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন টিভি দেখা বাচ্চাদের খেলা এবং সৃজনশীলতাকে বাড়িয়ে তোলে। আবার অধিকাংশই বলেছেন টিভি দেখা শুধুই নেগেটিভ প্রভাব ফেলে।
অনেকেই বলছেন টিভি দেখার কুপ্রভাব সবচেয়ে বেশি শিশুর সৃজনশীলতার উপর। প্রত্যেক শিশুই একটি সৃজনশীল মনের অধিকারী। আর এই সৃজনশীল মন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় টিভি দেখার ফলে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রত্যেক দিন যে শিশুরা ১৫ মিনিট বা তার বেশি সময় টিভি দেখে তাদের মনের সৃজনশীলতা অন্য শিশুদের তুলনায় কম।
যে সকল শিশুরা বই পড়া বা পাজল সমাধান করে তাদের সৃজনশীলতা অনেক ভালো হয়ে থাকে। তুলনামূলকভাবে যে সকল শিশু প্রিয় কার্টুন দেখতে গিয়ে ১৫ মিনিটের বেশি সময় টিভির সামনে কাটায়, তাদের সৃজনী শক্তি অনেক কম। এমন তথ্যই গবেষণায় উঠে এসেছে।
ব্রিটেনের স্টাফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার সারাহ রোজ শিশুর সৃজনশীলতার উপর টিভির প্রভাব দেখার জন্য একটি গবেষণা করেন। তাতে দেখা গেছে টিভি দেখার পর শিশুর মনে মৌলিক ধারনা উৎপাদনের হার অনেক কম থাকে। যদিও এই বিষয়টি অল্প সময়ের পর উধাও হয়ে যায়। তবে এই প্রভাব কিন্তু ভালো কিছু ঘটাতে সাহায্য করে না। সৃজনশীলতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়া শিশুর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিকাশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
আরো কয়েকটি মতবাদ আছে যা শিশুর সৃজনশীলতার সঙ্গে টিভি দেখার সম্পর্ক নিয়ে ধারণা পেতে সহায়ক হতে পারে। এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক সেগুলির কয়েকটি
আরো পড়ুন সন্তানের সঙ্গে আপনার সুন্দর সম্পর্ক থাকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ
-
স্টিমুলেশন হাইপোথিসিস
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে টিভি দেখার সঙ্গে শিশুর সৃজনশীলতার নেতিবাচক দিকের কথাই বলা হচ্ছে। অথচ স্টিমুলেশন হাইপোথিসিস কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। এই মতবাদের যুক্তি অনুযায়ী টেলিভিশনের চরিত্র ও ঘটনাগুলি শিশুদের খেলায় অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। এখানে যদিও সাধারনভাবে টিভি দেখার কথা বলা হয়নি, বরং শিক্ষামূলক কোন অনুষ্ঠান দেখার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। তারা দেখিয়েছেন যে শিক্ষামূলক কিছু দেখা শিশুর কল্পনাকে উদ্দীপিত করতে সক্ষম।
তবে অন্যদের মতে অন্তর্ভুক্তির মানে কিন্তু এমন নাও হতে পারে যে টেলিভিশনের বিষয় অপেক্ষা শিশুর খেলার বিষয় বেশি সৃজনশীল হয়ে উঠবে। সুতরাং সৃজনী শক্তি প্রভাবিত হচ্ছেই।
-
রিডাকশন হাইপোথিসিস
পূর্বের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মতবাদ রিডাকশন হাইপোথিসিস। এই মতবাদে বিশ্বাসী গবেষকরা সমর্থন করে নিয়েছেন যে টেলিভিশন দেখা সৃজনশীলতাকে বাড়ায় না, বরং অনেক কমিয়ে আনে। তবে কি হারে কম হয় তা নিয়ে যথেষ্ট মত পার্থক্য আছে।
আরো পড়ুন আপনার সন্তান ব্রাশ করতে চায় না? কিভাবে তাকে শেখাবেন?
-
আরো কিছু মতবাদ
স্টিমুলেশন হাইপোথিসিস ও রিডাকশন হাইপোথিসিস ছাড়াও আরো কয়েকটি মত রয়েছে, যেমন ডিসপ্লেসমেন্ট, প্যাসিভিটি, র্যাপিড পেসিং, ভিজুয়ালাইজেশন ইত্যাদি।
ডিসপ্লেসমেন্ট হাইপথিসিস বলছে, বাচ্চারা তাদের অবসর সময়ের একটি অংশ টেলিভিশন দেখার জন্য খরচ করে, যা আসলে কোন কল্পনাপ্রবণ খেলার জন্য ব্যবহার করা যেত। তাহলে এটি শিশুর সৃজনশীলতায় প্রভাব ফেলছে।
প্যাসিভিটি হাইপোথিসিস বলছে টিভি একটি খুব সহজ বিনোদনের মাধ্যম যার জন্য খুব সামান্যই মানসিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন। শিশুর সৃজনশীলতার জন্য যে কল্পনা শক্তির প্রয়োজন, টিভি সেই শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। ফলে শিশু আরো বেশি করে প্যাসিভ বা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ছে।
র্যাপিড পেসিং হাইপোথিসিস নামে আরেকটি মতবাদ এই সম্পর্কে কিছু কথা বলছে। টেলিভিশনের যে কোন অনুষ্ঠানেরই একটি নির্দিষ্ট গতি রয়েছে। এই গতি শিশুর কল্পনার উপর প্রভাব ফেলে বলে দাবী করা হচ্ছে। কেননা টেলিভিশনে উপস্থাপনার গতি শিশুর মস্তিষ্কের প্রসেসিং এর গতির চাইতে অনেক দ্রুত। যার ফলে শিশু তার মস্তিষ্কে এগুলি প্রক্রিয়া করতে পারছে না। এছাড়া সৃজনশীল কাজে দীর্ঘ সময়ের জন্য মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হয়। টেলিভিশন এই ব্যাপারেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে।
আরো পড়ুন কীভাবে আপনার সন্তানের মধ্যে সমস্যা সমাধানের স্কিল গড়ে তুলবেন?
কেন কমে যাচ্ছে শিশুর সৃজনশীলতা ?
অতিরিক্ত টিভি দেখার ফলে শিশুদের কল্পনাপ্রসূত খেলা বা চিন্তা ভাবনার যে মৌলিকতা তার মধ্যে প্রভাব পড়তে থাকে। অর্থাৎ টিভিতে দেখা বিষয়গুলির সঙ্গে তাদের কল্পনা ক্রমশ মিশে যেতে থাকে। ফলে শিশুর কল্পনাপ্রসূত খেলা বা অন্যান্য চিন্তাধারার সঙ্গে টিভিতে দেখা বিষয়গুলির যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। সামগ্রিকভাবে টিভি দেখার সঙ্গে শিশুর কল্পনাপ্রবণ খেলা বা সৃজনশীলতার কোন ইতিবাচক সম্পর্ক আদৌ নেই। কোন গবেষণাই এখন পর্যন্ত তেমনটা প্রমাণ করতে পারেনি। বেশিরভাগ গবেষণাই একথা স্বীকার করে নিয়েছে যে টেলিভিশন দেখা শিশুর সৃজনশীলতা বাড়ানোর পরিবর্তে হ্রাস করে থাকে। শিশুর কল্পনাপ্রবণ মনের উপর আসলেই এর প্রভাব নেগেটিভ।
আজকের ব্লগটি পড়ে আপনাদের যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন, আজকের ব্লগ সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করে জানান।
আরো পড়ুন-
Good Handwriting:শিশুর হাতের লেখা সুন্দর করতে মেনে চলুন এই টিপসগুলি
বিজ্ঞানের প্রতি শিশুর ঝোঁক বাড়াতে মেনে চলুন এই টিপসগুলি