সন্তানের মূল্যবোধ গঠনে আপনার কর্তব্য

সন্তানের মূল্যবোধ গঠনে আপনার কর্তব্য

বর্তমানে মা-বাবা উভয়েই কর্মক্ষেত্রে যুক্ত থাকার ফলে সন্তান কে সময় দিয়ে উঠতে পারেন না। এর অনেকটাই পূরণ করার চেষ্টা করেন ফোন, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ইত্যাদি দিয়ে। ফলে বাচ্চাদের মধ্যে যে কোন জিনিস ই খুব সহজলভ্য এমন বিশ্বাস ক্রমেই গড়ে উঠতে শুরু করে। আজকাল একটি অতি পরিচিত ছবি বাচ্চার হাতে ফোন বা কার্টুন দেখিয়ে খাবার খাওয়ানো। এতে করে বাচ্চাদের চোখের ক্ষতি যেমন হচ্ছে, পাশাপাশি নানারকম মানসিক সমস্যা ও দেখা দিচ্ছে। যেমন ধৈর্য কমে যাওয়া, ইম্পালসিভনেস ইত্যাদি যা শিশুর জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এছাড়া শিশুর মধ্যে যে মূল সমস্যা তৈরি হচ্ছে যে জেদই তার সমস্ত ইচ্ছাপূরণের একমাত্র চাবিকাঠি। বর্তমানে একটি বা দুটি সন্তানের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে সন্তান ই বাবা-মায়ের মনোযোগের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু, একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই। সন্তান কে অবশ্যই ভালোবাসুন। তবে ছোটবেলা থেকেই তাকে কিছু কিছু মূল্যবোধের শিক্ষাও দিন। মনে রাখবেন স্কুলের ক্যারিকুলাম যত সমৃদ্ধই হোক না কেন, আপনার দেওয়া মূল্যবোধ ই শিশুর জীবনকে সুন্দরভাবে রচনা করবে, তার মধ্যে জীবনবোধের বিকাশ ঘটাবে।

দিনের কিছুটা সময় বাচ্চাকে বই পড়ার জন্য নির্দিষ্ট করে দিন। আপনার শৈশবের দিনগুলি মনে করে ঠাকুমার ঝুলি, হিতোপদেশ তুলে দিন আপনার শিশুর হাতে। এতে করে তাদের নৈতিক বিকাশ যেমন হবে, তেমন ই বই পড়ার সুঅভ্যাসের দরুন ফোন বা গ্যাজেটের প্রতি অসক্তির সম্ভাবনা অনেক কম হবে।

  • সন্তানের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটান

কর্মব্যাস্ততার কারনে সময় বের করা কঠিন হলেও সারাদিনে কিছুটা সময় অন্তত সন্তানের সঙ্গে কাটানোর জন্য রাখুন। তাদের সঙ্গে গল্প করুন, তাদের কথা ও শুনুন, আপনার বড় হয়ে ওঠার গল্প তাকে বলুন, ভালো খারাপের মধ্যে বিচার করতে শেখান। শুধুই প্রাচুর্যের মধ্যে না রেখে তাকে কখনও অভাব ও বুঝতে দিন।

  • সুঅভ্যাস গঠন

সকালে উঠে শরীরচর্চা করা, প্রার্থনা করা অথবা সকলকে “গুডমর্নিং” “থ্যাঙ্ক ইউ” বলা ইত্যাদি বিষয়গুলো শেখান। এই অভ্যাসগুলো তার মধ্যে সৌজন্যবোধের বিকাশ ঘটাবে। এছাড়া বড়দের কাজে সাহায্য করা, নিজের জিনিস গুছিয়ে রাখা এগুলো ছোট থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে তুলুন। নিজের কাজ নিজে করতে শেখান। এতে শিশুর মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতার বিকাশ ঘটবে, শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব গড়ে উঠবে।

আরো পড়ুন সন্তানের মূল্যবোধ গঠনে আপনার কর্তব্যঃ 

  • পরিবেশ বান্ধব হতে শেখান

অধিকাংশ বাড়িতেই উঠোনের সুবিধা এখন আর নেই।  ফ্ল্যাটের জীবন যাপনে এক টুকরো ব্যালকনি ই সম্বল। সেখানেই  ফুলের চারা বা পাতাবাহারের টব রাখতে পারেন। বাচ্চাকে রোজ গাছে জল দেওয়া শেখান। বিভিন্ন গাছের সঙ্গে পরিচিত করুন। করতে পারেন ভেষজ উদ্যান ও। গাছ-গাছালির গুনাগুন বর্ণনা করুন। বড়দের কাজে সাহায্য করতে ওরা কিন্তু সর্বদাই উৎসাহীই থাকে। ছোটখাটো দায়িত্ব পালন শিশুর মধ্যে উৎসাহ তৈরি করে ও তার মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলে। গাছের পরিচর্যায় আপনার সঙ্গে তাকেও  নিন।  প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে দিন।

এছাড়া আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা, ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা ইত্যাদি অভ্যাসগুলি ও শৈশব থেকেই তৈরি হওয়া একান্ত প্রয়োজন। মনে রাখবেন শৈশবে শিশুর আত্মিকরণের ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে। এই সময় আপনি শিশুর মধ্যে যত বেশি সুঅভ্যাস গঠন করতে পারবেন, আপনার সন্তানের জীবন ততই সুন্দর হবে।

  • খেলাধুলায় উৎসাহ দিন

মনে করে দেখুন আপনাদের শৈশবের দিনগুলি। পৃথিবীর কোন শক্তিই সে সময় বিকেলবেলার মাঠে ছুটে যাওয়াকে আটকাতে পারত না। এখন বাচ্চারা তাদের শৈশবকেই উপভোগ করে উঠতে পারে না। পিতামাতা হিসাবে এই কর্তব্যও আপনার উপরেই বর্তায় যেন আপনার সন্তান একটি সুন্দর শৈশব কাল যাপন করতে পারে। বিকেলবেলা তাকে পার্কে নিয়ে যান, আশেপাশের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সন্তানদের সঙ্গে খেলাধুলার সুযোগ করে দিন। তবে তা যেন কখনই মোবাইল বা কম্পিউটারের গেম না হয়।

আরো ভালো হয় যদি আপনার সন্তান কে কোন স্পোর্টসের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন। কোন ধরনের খেলাধুলায় সে আগ্রহী তা জেনে নিন। তার পছন্দ কেও প্রাধান্য দিন। অযথা আপনার সিদ্ধান্ত কে চাপিয়ে দেবেন না যেন। আজকাল বহু অভিভাবকই খেলাধুলার বিষয়টিকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করেন না। এমন মনোভাব যে সঠিক নয় সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। পড়াশোনার পাশাপাশি যে কোন স্পোর্টসই শিশু কে নিয়মানুবর্তিতা শেখানোর ক্ষেত্রে অনেক বেশি সহায়ক হয় এবং তার শরীর ও মন কে চনমনে রাখতে সাহায্য করে।

আরো পড়ুন কীভাবে আপনার সন্তানের মধ্যে সমস্যা সমাধানের স্কিল গড়ে তুলবেন? 

  • নিজেও মূল্যবোধের অনুশীলন করুন

বিখ্যাত সাইকলজিস্ট এলবার্ট ব্যান্দুরা তার সোশ্যাল লার্নিং থিওরি তে বলেছেন, বাচ্চারা তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশে অন্যান্য ব্যাক্তিদের ব্যবহার, আচার- আচরণ দেখেও বহু বিষয় শেখে। মনে রাখবেন অনুকরণ শিশুদের একটি অন্যতম প্রবনতা। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন বাচ্চারা সবসময়ই বড়দের অনুকরণ করে থাকে। আপনার বসার ধরন, হাঁটার ভঙ্গি, বিশেষ কোন অভ্যাস, আদবকায়দা সব কিছুই শিশু রপ্ত করার চেষ্টা করে। কাজেই বাচ্চাকে মূল্যবোধ শেখানোর জন্য প্রথমেই সেগুলো আপনাকে অনুসরণ করতে হবে। আপনি যে সকল সুঅভ্যাস বা আচরণ বাচ্চার মধ্যে দেখতে চাইছেন, তা আগে নিজে আয়ত্ত করুন। নতুবা আপনি যত নৈতিকতাই শেখান না কেন তা ফলপ্রসূ হবে না। শিশু কেবল সেগুলোই বেছে নেবে যা আপনার বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আচরণে প্রকাশ পাবে।