মোবাইল ছাড়া বাচ্চাকে খাওয়ানোই যাচ্ছে না। খাবার নিয়ে বসলে কেটে যাচ্ছে প্রায় ঘন্টা দুয়েক। কিন্তু মোবাইলে গেম চালিয়ে দিয়ে খাওয়াতে বসলেই বেশি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না। শিশুর মনোযোগ গেমের দিক, আর মা তার মুখে ঠুসে দিচ্ছেন খাবারের গ্রাস। শিশু হয়তো খেয়ালও করছে না আদৌ সে কি খাচ্ছে।
যে কোন বয়সের বাচ্চারাই মোবাইলের গেমের নেশায় বুঁদ। আর হাতে মোবাইল না দিলেই বাড়িতে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার উপক্রম।
প্রায় সব বাচ্চারাই আজকাল নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বড় হচ্ছে। ফলে তারা দাদু ঠাকুমার সান্নিধ্য লাভ করা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। শিশুর বিনোদনের উপায় হিসেবে অভিভাবকেরা যোগান দেন মোবাইল ফোনের মত আরো নানা ধরনের ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের।
আবার বহু অভিভাবক এমনও আছেন যারা কিনা রীতিমতো গর্বিত সন্তানের স্মার্টফোন ব্যবহারের পারদর্শিতা নিয়ে। “আমরা অত বুঝি না, কিন্তু ছেলে ফোনের সব জানে” এই বলে অনেককে গর্ব করতেও দেখবেন। আপনার কাজের সুবিধা হচ্ছে হয়তো, আপনি সন্তানের স্মার্টফোনে চৌখস হওয়ায় হয়তোবা গর্বিত, কিন্তু স্মার্টফোন হাতে দিয়ে আপনিই সবচেয়ে বড় বিপদ ডেকে আনছেন সন্তানের জীবনে। সচেতন হোন আজ থেকেই।
● দেহের উপর যে প্রভাব পড়ছে
ঘন্টার পর ঘন্টা বাচ্চার দখলে মোবাইল । এক নাগাড়ে গেম খেলেই যাচ্ছে। শুধুমাত্র দেহের উপরেই স্মার্টফোনের প্রচুর কুপ্রভাব। এই যে এতক্ষণ ধরে ফোন হাতে বসে আছে, স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতেই নারাজ। এর ফলে শিশুদের হাঁটাচলা, ওঠাবসা প্রায় হচ্ছে না বললেই চলে। ফলস্বরূপ অনেক ছোট থেকেই স্থূলতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে বাচ্চারা।
খাবার সময়েও ফোন চাই। নাহলে খাওয়ানোই যাচ্ছে না। ফোনের দিকে তাকিয়ে খাবার ভালো মত চিবিয়ে খাচ্ছে না শিশুরা। দেখা দিচ্ছে হজমের সমস্যা।
এতক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে চোখের সমস্যা তো হরদম শিশুদের লেগেই রয়েছে
ফোনের থেকে যে রেডিয়েশন বের হচ্ছে তা যে কোন প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও ভালো নয়। তাহলে শিশুর দেহের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সে কথা চিন্তা করে দেখেছেন কখনও?
সম্প্রতি গবেষণায় উঠে এসেছে আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য যা না বললেই নয়। অত্যধিক টাচস্ক্রিন ব্যবহার প্রভাব ফেলছে শিশুর লেখার দক্ষতার উপর। হাতের আঙ্গুল এবং কব্জির বিশেষ উপায়ে সংকোচন প্রসারণের দ্বারা শিশুর লিখতে পারার দক্ষতা অর্জন করে। এর উপরেও থাবা বসিয়েছে স্মার্টফোন। অত্যধিক স্মার্টফোন ঘাটার ফলে শিশুর আঙ্গুল, হাতের পেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। যে কারণে তাদের লিখতে পাড়ার ক্ষমতা কমে আসছে।
আরো পড়ুন- গুড পেরেন্টিং এর 10 টি নীতি
● মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে স্মার্টফোন
বেড়ে ওঠার সময় একটি শিশুর মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক গুণের বিকাশ হতে থাকে। যেমন ধরুন ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ওপরের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা এগুলোই আর কি। কিন্তু জানেন কি ফোনের মধ্যে ঘাড় গুঁজে থাকার ফলে ক্ষতি হচ্ছে এসব দিকেরও? দীর্ঘ সময় ফোনে ব্যস্ত থাকার জন্য শিশুর মনোযোগের ঘাটতি যেমন হচ্ছে তেমনই তারা অনেক বেশি ইমপালসিভ হয়ে পড়ছে। অল্পতেই রেগে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ- শিশুদের ক্ষেত্রে এগুলো আজকাল খুবই সাধারণ লক্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভার্চুয়াল দুনিয়ার ক্যারেক্টারই তাদের জীবনে মুখ্য হয়ে যাচ্ছে। অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করতে বাচ্চারা আর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, উৎসাহও তেমন নেই।
হাতে ফোন ধরিয়ে আপনি হয়তো নিশ্চিন্তে কাজ সাড়তে পারছেন কিন্তু আপনার সজাগ দৃষ্টি না থাকার কারণে সন্তান এমন কোন আপত্তিকর বা অনৈতিক বিষয়ের সামনে পড়ে যেতে পারে যা তার পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। ব্লু হোয়েলের মত গেমের নাম তো আমরা সকলেই শুনেছি। আপনার উদাসীনতা কিন্তু শিশুর কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
● ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে ঘুমের
ঘুমের সময়েও ফোন চাই। ফোনের সঙ্গ ছাড়া সবই যেন অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে বাচ্চাদের ডেইলি রুটিনে। চাইছেন বাচ্চা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে তাই আপনিও মোবাইল দিয়েই দিচ্ছেন।
আগে মা ঠাকুমার কাছে গল্প শুনে শিশুর ঘুম আসতো। এখন সেই গল্পই চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্মার্টফোনে। এতেও ক্ষতির পরিমাণ কিছু কম নয়। শিশুদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে স্লিপিং ডিসঅর্ডার। মোবাইল ব্যবহার শিশুর মস্তিষ্ককে হাইপার এক্টিভ করে তোলে। দু মিনিট ফোন ব্যবহারের রেশ থেকে যায় দু ঘন্টার মত। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব শারীরিক নানা সমস্যাও তৈরি করছে।
স্মার্টফোন ব্যবহার করা মানেই কিন্তু স্মার্ট হওয়া নয়। প্রযুক্তির গ্রাস থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখাই স্মার্ট হওয়ার রাস্তা দেখাতে পারে। আমরা মনে করি আমরা ফোন চালাচ্ছি, কিন্তু আসল সত্য হল ফোনই আমাদের চালনা করছে। বাচ্চা বায়না করলেই যে তাকে ফোন দিতে হবে এমন নয়। কাজের বিঘ্ন যাতে না ঘটে সেজন্য অনেক অভিভাবক এমন রয়েছেন যারা শিশুর গেম খেলার জন্য আলাদা করে তার হাতে ফোন তুলে দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাচ্চাদের হাতে ফোন তুলে দেওয়া যে কোন মাদক তুলে দেওয়ার সমতুল্য। কেননা এটিও আসক্তি তৈরি করছে যা সহজে ছাড়ার নয় বরং দিন কে দিন বেড়েই চলবে।
বিশ্বের বহু উন্নত দেশ আঠারো বছরের নিচে স্মার্টফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আমাদের দেশে সরকারের সেই সচেতনতা কবে আসবে, কবে পদক্ষেপ নেওয়া হবে সেই ভাবনায় বসে থেকে সময় নষ্ট করবেন না। সন্তান আপনার, তার ভবিষ্যতের দায়িত্বও আপনার। সে কথা মাথায় রেখে নিজে উদ্যোগ নিন। বাচ্চাকে স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখুন।
প্রশ্নঃবাচ্চার ফোনের নেশা যাতে না তৈরি হয় সেজন্য অভিভাবকদের করণীয় কি?
যতখানি সম্ভব নিজেরা ফোন কম ব্যবহার করুন।
প্রশ্নঃফোনের আসক্তি ছাড়াতে হলে এখন কি করবো?
খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে পারেন, বা নন ফিকশন বই পড়ানোর অভ্যাস করাতে পারেন।
প্রশ্নঃবাচ্চার মধ্যে গেম খেলার নেশা যাতে না হয় সেজন্য কি করা উচিৎ?
ফোনে গেম রাখবেন না, সঙ্গে পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখুন।
আরো পড়ুন-
বিজ্ঞানের প্রতি শিশুর ঝোঁক বাড়াতে মেনে চলুন এই টিপসগুলি
শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটবে
স্কুলে যাওয়ার সময় বাচ্চা কেঁদে ভাসাচ্ছে । জেনে নিন আপনার করণীয় কি?
সন্তানের মধ্যে এই লক্ষনগুলি দেখা দিলে এক্ষুনি সচেতন হন