আজকাল নারী পুরুষ সমানাধিকারের কথা খুব প্রচলিত একটি ধারণা। সর্বত্রই নারী ও পুরুষের অধিকার সমান হওয়া উচিৎ এমন একটি ভাবনা মোটামুটি সমাজের সকল ক্ষেত্রেই কম বেশি লক্ষ্যনীয়। কিন্তু সত্যি কি নারী ও পুরুষ অধিকারের দিক থেকে সমান হয়েছে। না হওয়ার পেছনে যে কারন তার সুত্রপাত কোথায়?
আসলে এর সুত্রপাত পরিবারেই অন্দরেই বিদ্যমান। কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তানের মধ্যেকার বিভেদ এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। এই প্রবণতা ভারতীয় পিতা মাতাদের মধ্যে প্রবল। মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এর বীজ। যদিও এখন বাবা মায়েরা পুত্র এবং কন্যা সন্তান কে আলাদা ভাবে না দেখার মনোভাবই রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজেদের অজান্তেই কিছু ভুল হয়ে যায়। আপনি নিজের অজান্তেই এমন ভুল করে ফেলছেন না তো। চলুন দেখে নেওয়া যাক এমন কিছু টিপস যাতে করে কন্যা সন্তান কে বড় করার সময় কোন ভাবে তার প্রতি বৈষম্য না করে ফেলেন।
মেয়ের সামনে বৈষম্য দেখাবেন না
মেয়ের সামনে ছেলেকে উন্নত প্রমাণ করতে গিয়ে তাকে ছোট করে ফেলবেন না যেন। আপনার অজান্তেই বৈষম্যের বীজ এখানে পোঁতা হয়ে যায়। কখনও হয়তো ভাইবোন খেলতে গিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়ে গেছে। তুমি মেয়ে, তুমি জোরে কথা বলবে না বা মেয়েদের মারপিট করতে নেই- এই ধরণের কথা বলবেন না।
শৈশবেই লিঙ্গ বৈষম্য করে ফেলবেন না যেন
মেয়ে সন্তান হলে সে পুতুল, রান্নাবাটি এগুলোই পছন্দ করবে এমন টা আমরা আগে থেকেই ভেবে নিই। শৈশবে তাদের যখন খেলনা কিনে দিচ্ছেন তখন মেয়েকে একটি কিচেনসেট আর ছেলেকে কিনে দিলেন একটি বন্দুক। কিন্তু কখনও তাদের কাছে জানতে চেয়েছেন কি আদতে তাদের কোনটা পছন্দ?
অথবা এমন হল আপনার মেয়েকে কেউ জিজ্ঞাসা করেছে সে বড় হয়ে কি হতে চায়, উত্তরে সে বলল সে আর্মি জয়েন করতে ইচ্ছুক। এই সময় আপনি তাকে কখনই বলবেন না যে তুমি মেয়ে, তুমি কেন আর্মি তে চাকরি করতে চাইছো, তুমি স্কুল টিচার হও। পেশার প্রতি এমন বৈষম্য কখনই পিতামাতার থেকে কাম্য নয়। সমাজের যে কোন ক্ষেত্রকে বৈষম্যমুক্ত করতে অভিভাবকের ভূমিকাও কিছু কম নয়। কেননা আমাদের উন্নত মন মানসিকতা পরিবারের মধ্য থেকেই তৈরি হয়। বৈষম্য দূর করতে প্রথম পদক্ষেপ টা নাহয় আপনিই নিলেন।
আরো পড়ুন সন্তানের মূল্যবোধ গঠনে আপনার কর্তব্যঃ
কন্যা সন্তান কে কম গুরুত্ব দিচ্ছেন কি? খেয়াল করুন
কন্যা সন্তান অপেক্ষা পুত্র সন্তান কে যে কোন ব্যাপারেই অধিক গুরুত্ব দেওয়া ভারতীয় পিতা-মাতাদের মধ্যে খুবই প্রচলিত একটি ব্যাপার। পুরনো দিনের পরিবার ব্যবস্থা লক্ষ্য করলে দেখা যেত মাছের বড় টুকরো হোক কিংবা দুধের সর- তুলে রাখা হত পুত্র সন্তানের জন্যই। যদিও বর্তমানে এই চিত্র অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। তবে একেবারেই যে সবটা ধুয়ে মুছে গেছে এমন টাও নয়।
মেয়ে অন্যের বাড়ি চলে যাবে এবং ছেলেই আমাদের একমাত্র ভরসা- এই মনোভাব থেকে বহু বাবা মায়ই সবচেয়ে ভালো জিনিস টি ছেলেকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে মেয়েকে একটু কম দিলেও চলবে ভেবে থাকেন। খেয়াল করুন আপনিও মেয়ের প্রতি এমন বৈষম্য করে ফেলছেন না তো। তাহলে সতর্ক হোন। আজকাল এমন মিথ একেবারেই অতীত হয়েছে। বহু মেয়েই এখন একমাত্র কন্যা সন্তান এবং সংসার, কর্মক্ষেত্র ও পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে থাকে। ফলে কন্যা সন্তানও আপনার ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারে এ কথা আপনাকে সবার আগে উপলব্ধি করতে হবে।
রান্নাঘরে শুধু মেয়েকেই ডেকে নিচ্ছেন কি?
খাবার তৈরি, ঘর পরিষ্কার রাখা, লন্ড্রি ইত্যাদি একেকটি লাইফ স্কিল। ফলত ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সকলেরই এগুলি জানা প্রয়োজন। আমাদের ভারতীয় সমাজে দেখা যায় মা কেবল মেয়েকেই রান্না শেখাতে উদ্যোগী। ঘর গৃহস্থালির কাজে শুধু মেয়েদের ই উৎসাহিত করা হয়। তাকে ঘরকন্যার কাজ শিখিয়ে তবেই বিবাহ উপযোগী করা যাবে। এ যেন শুধুই তার বিবাহ পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি পর্ব।
একবিংশ শতাব্দীতে এমন মানসিকতা বহন করলে এক্ষুনি তা থেকে বেরিয়ে আসুন। ঘর গৃহস্থালির কাজে আপনার ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের দায়িত্ব সমান এবং ছোট থেকেই তাদের একথা উপলব্ধি করতে দিন। কন্যা সন্তান বলে আপনার মেয়েকে গৃহকর্মে নিপুন হতেই হবে- একথা কোথায় লেখা আছে বলতে পারেন ?
আরো পড়ুন কীভাবে আপনার সন্তানের মধ্যে সমস্যা সমাধানের স্কিল গড়ে তুলবেন?
মেয়েকেও সিদ্ধান্ত নিতে দিন
মেয়ের জন্য কোনটি ভালো হবে আর কোনটি নয় সেই সিদ্ধান্ত সাধারনত মেয়েটি ব্যাতীত বাড়ির অন্য সদস্যরা নিয়ে থাকে, এমন দৃষ্টান্ত বহু রয়েছে। মেয়ের পড়াশোনা হোক বা খেলাধুলো সব ব্যাপারেই আপনি শেষ কথা বলছেন। এমন টা না করে তাকে ও কোন কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। মেয়ে ক্রিকেট খেলতে চাইলে তাকে তাই খেলতে দিন, এমন নয় যে মেয়ে সন্তান বলে তাকে ক্রিকেট খেলতে বারণ করে দেবেন। এরপর প্রাপ্তবয়স্ক হলে মেয়ের পড়ার বিষয় কি হবে, ভবিষ্যতে সে কোন পেশায় নিজেকে যুক্ত করবে, কলেজের ফিস্টে যাবে কি না- এই ধরণের ব্যাপারে মেয়ে অপেক্ষা বাকিদের সিদ্ধান্ত কে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার চল রয়েছে। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, যে কোন বিষয়েই যে আপনার মেয়ের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন, তার নিজস্ব মতামত কে কোন গুরুত্বই দিচ্ছেন না, এমন টা কি হওয়া উচিৎ? সব ব্যাপারে বৈষম্য না করে্, বাধা না দিয়ে তাকেও জীবন কে উপভোগ করতে দিন। মেয়ের প্রতি বৈষম্য সম্পর্কে সচেতনতা আনুন, সুন্দর সমাজ গঠনে আপনি ও একজন অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠুন। সরকারের একগুচ্ছ স্কিম আইন তৈরি করে নয়, সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা তখন ই সফল হবে যখন আমার আপনার মানসিকতার পরিবর্তন হবে।