পেরেণ্টিং বা অভিভাবকত্ব বলতে কি বোঝায়?
পেরেণ্টিং হচ্ছে শিশুর শারীরিক, মানসিক, নৈতিক দিক সমূহের যথাযথ বিকাশের প্রক্রিয়া। শিশুর বয়স অনুযায়ী তার সঠিক বিকাশ হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তার পরিচর্যা করা। সংক্ষেপে পেরেণ্টিং বা অভিভাবকত্ব কে সংজ্ঞায়িত করে বলা যায় একটি শিশুকে তার জন্মত্তর লগ্ন থেকে সাবালকত্ব কাল পর্যন্ত পরিচর্যা করে তাকে পূর্ণতাপ্রাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এর পাশাপাশি তাকে এমন একটি পরিবেশ প্রদান করা যেখানে সে নিজেকে নিরাপদ অনুভব করে। আরো সহজভাবে বলতে হলে আপানার বাচ্চাকে কোনটা শেখাবেন, কিভাবে শেখাবেন, কিভাবে তাকে মানুষের মত মানুষ করবেন এই সমস্ত কিছুই পেরেণ্টিং এর অন্তরভুক্ত। বাবা-মায়ের পেরেণ্টিং এর উপরেই শিশুর বিকাশের দিকটি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে থাকে। শিশুর চিন্তাধারার বিকাশ, তার সামাজিক দক্ষতা, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, তার বুদ্ধিবৃত্তি, সৃজনশীলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের মত বৈশিষ্ট্যগুলি পিতামাতার দক্ষ পেরেণ্টিং এর ফলেই গড়ে ওঠে।
বহু পিতামাতাই সেরা স্কুলে ভর্তি করা বা ভালো টিচার দিয়ে পড়ানো কেই আজকাল উৎকৃষ্ট পেরেণ্টিং হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। তবে এমন মনোভাব কখনই সঠিক নয়। যে বিষয়টি আমরা ভুলে যাই যে পেরেণ্টিং এর সময় আমাদের ছোট ছোট ভুল শিশুর আগামী জীবনে বা তার ব্যাক্তিত্বের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। যে কোন মা বাবাই তার সন্তান কে সব চাইতে ভালো পরিসেবাই দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শুধু ভালো স্কুলে ভর্তি করলেই তা আদর্শ পেরেণ্টিং হয় না। সন্তানের সুন্দর জীবন গঠনে আপনার দেওয়া শিক্ষাই শেষ কথা। আপনার ব্যাস্ত জীবনের তালিকা থেকে কিছুটা সময় অবশ্যই সন্তানের জন্য রাখুন। গান বা কবিতা শোনাতে পারেন,গল্প বলতে পারেন, ফ্যামিলি টাইম কাটান। তাকে এক্সট্রা ক্যারিকুলার এক্টিভিটি তে যুক্ত করুন। এগুলো কখনই সময়ের অপচয় নয়, বরং শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশে অনেক বেশি সহায়ক হয়।
পেরেণ্টিং এর ক্ষেত্রে আপনার মূল দায়িত্ব
আমরা সকলেই জানি সদ্য হওয়া যে কোন পিতামাতার জীবনই এক ধাক্কায় কতখানি পাল্টে যায়। তবে শুধুমাত্র বাচ্চাকে খাওয়ানো বা তার ডাইপার বদলানোর মধ্যেই পেরেণ্টিং সীমাবদ্ধ থাকে না। শিশুর নিরাপত্তা প্রদানের দিকটিও এক্ষেত্রে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। যেমন কোন কেমিক্যাল প্রোডাক্ট বা ইলেকট্রিক জিনিস তার নাগালের বাইরে রাখার মত বিষয়গুলির খেয়াল রাখা। আবার শিশু যখন আরো একটু বেড়ে উঠছে , তখন এই নিরাপত্তার ব্যাপারটি সাবধানে রাস্তা পার করা বা অচেনা ব্যাক্তির থেকে দুরত্ব বজায় রাখার মত বিষয়ে বদলে যায়।
এছাড়া শিশুকে একজন স্বাধীন ব্যাক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলাও আপনার পেরেণ্টিং এর একটি অন্যতম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শিশুর নিজস্ব কাজগুলি সবসময় আপনি না করে তাকে নিজেকে করার সুযোগ করে দিন। ভুল-ভ্রান্তি হলে তা শুধরে দিন। আরো বেশি উৎসাহিত করুন। এতে শিশুর মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতার মনোভাব তৈরি হবে।
আরো পড়ুন গুড পেরেন্টিং এর 10 টি নীতি
পেরেণ্টিং এ যা আপনার অবশ্য করনীয়
সন্তানের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকটি সুনিশ্চিত করার জন্য মা-বাবা সর্বদাই তৎপর। কিন্তু এই সব কিছুর মধ্যেও এমন কতকগুলি বিষয় রয়েছে যেগুলি সম্পর্কে আপনার বিশেষভাবে যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। আপনি এখন প্রোভাইডার। শিশুর যে কোন প্রকার চাহিদার যোগান আপনাকে দিতে হবে।বহুক্ষেত্রে এমনটা লক্ষ্য করা যায় কাজের ব্যাঘাত ঘটার দরুন অভিভাবক বাচ্চার উপর বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলছেন। এমন ব্যবহার শিশুর মানসিক স্বাস্থের উপর কুপ্রভাব ফেলে থাকে। আপনাকে অনুকরণ করতে গিয়ে পরবর্তীতে সেও যে কোন ব্যাপারে এমন বিরক্তি প্রকাশ করা কেই স্বাভাবিক বলে ধরে নেবে এবং তদনরুপ আচরণ করবে। তাকে স্নেহ করুন, আগলে রাখুন, তাকে নিরাপদ অনুভব করতে দিন। শিশুর পরিচর্যায় বাড়িতে একটি ইতিবাচক পরিবেশ বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
গুড পেরেণ্টিং এর জন্য যে গুণাবলী আপনার মধ্যে থাকা জরুরি
আপনার পেরেণ্টিং যাতে যথাযথ হয় তার জন্য সবার আগে আপনার মধ্যেই কিছু গুণাগুণ থাকা বাঞ্ছনীয়।
শিশু বেড়ে উঠতে শুরু করলে তার আচরনের মধ্যে একগুঁয়েমি, জেদ, খামখেয়ালীপনা প্রকাশ পেতে থাকে। শিশুর এমন আচরণধারার সঙ্গে বুঝতে হলে আপনাকে ধৈর্য্য রাখতে হবে।
ভালো পেরেণ্টিং এর জন্য আপনার মধ্যে ধারাবাহিকতা থাকা একান্ত প্রয়োজন। শিশুর সুঅভ্যাস গঠন হোক বা কোন বিষয়ে শিক্ষা – সব ক্ষেত্রেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা দরকার।
কোন আচরণ বা অভ্যাস যা আপনি শিশুকে শেখাতে চাইছেন, তা আগে নিজে রপ্ত করুন। শিশুর মধ্যে সর্বদাই অনুকরণের প্রবণতা কাজ করে। ফলত আপনার ব্যবহারে প্রকাশিত আচরণ শিশু সহজেই শিখে ফেলে।
সন্তানের পছন্দ অপছন্দ কে গুরুত্ব দিন। জোর করে আপনার সিদ্ধান্ত তার উপর চাপিয়ে দেবেন না। সন্তানের ভালো লাগা মন্দ লাগা গুলোর মূল্য দিন। শিশুর সঙ্গে সময় কাটান, তাকে বোঝার চেষ্টা করুন, তার চাহিদা জানার চেষ্টা করুন।
শিশুর প্রাইভেট বডি পার্ট সম্পর্কে তাকে সচেতন করুন, তাকে গুড টাচ ব্যাড টাচের ধারণা দিন। এ ব্যাপারে সংকোচ করবেন না। স্বাভাবিক কথপকথনের মাধ্যমেই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। শিশু ও যাতে এ ব্যাপারে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে টা সুনিশ্চিত করুন।
পেরেণ্টিং কখনই একটি সহজ কাজ নয়। ধৈর্য্য, শ্রম, যত্নশীলতা – এই সকল গুণের সমন্বয় হল পেরেণ্টিং। পেরেণ্টিং জার্নিতে একের পর এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন আপনাকে হতে হবে এবং তার মোকাবিলা করার জন্য সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা আপনার মধ্যে থাকা জরুরী।
Pingback: কর্তৃত্বপূর্ণ অভিভাবক হয়ে ওঠার ১২ টি উপায় – Parenting