পেরেন্টিং স্টাইল হল সেই কৌশল যার সাহায্যে আপনি সন্তান কে বড়ো করে তুলছেন। সন্তানের আচার-আচরণ, তার মনোভাবের ছাঁচ গঠনের ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে আপনার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার পেরেন্টিং স্টাইলই নির্ধারণ করে সন্তানের আগামী জীবনের ভিত কেমন হবে। শিশুর আচরণ আসলে আপনার পেরেন্টিং স্টাইলেরই প্রতিফলন। ব্যাক্তি হিসেবে আপনার সন্তান কেমন হবে, তার বিকাশ কোনদিকে হবে তা সম্পূর্ণভাবে আপনার উপর নির্ভর করছে। গোরার দিকে শিশুর শুধু কথা বলা বা কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ করে তা নয়, বরং এই সময় তাদের ব্যাক্তিত্বও তৈরি হতে শুরু করে। অভিভাবক হিসেবে পেরেন্টিং স্টাইল বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলি মাথার রাখা অত্যন্ত জরুরী। আসুন জেনে নেওয়া যাক পেরেন্টিং স্টাইলের কিছু ধরণ সম্পর্কে-
ডেভেলোপমেন্টাল সাইকোলজিস্ট Diana Baumrind দীর্ঘ পঁচিশ বছর গবেষণা পেরেন্টিং মূল চারটি ধরণ সম্পর্কে ব্যাখা করেছেন।
দেখে নেওয়া যাক এগুলি কি কি
Authoritative বা কর্তৃত্বসম্পন্ন
এই ধরণের পেরেন্টিং স্টাইলে অভিভাবক এবং সন্তানের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার বিষয়টি খুব স্পষ্ট। এখানে অভিভাবক তাদের সন্তানের প্রতি অধিক যত্নশীল হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে সন্তানের প্রতি উচ্চাকাঙ্খা থাকে ঠিকই তবে সন্তানের মতামতই এখানে প্রধান। আপনি যদি কর্তৃত্বসম্পন্ন পেরেন্টিং স্টাইল অনুসরণ করতে চান, তাহলে শুধুই সন্তানের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে হবে না। আপনাকে হতে হবে নমনীয়, সন্তানের মতামত শুনতে হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহনে তাকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
Authoritative অভিভাবকদের সন্তনেরা সাধারনত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে যে সকল শিশু কর্তৃত্বসম্পন্ন অভিভাবকত্বে বেড়ে ওঠে তারা নিজেদের স্বাধীন ব্যাক্তিসত্ত্বার বিকাশে সক্ষম হয় এবং তাদের মধ্যে মানসিক ব্যাধির আশঙ্কা অনেক কম হয়, কঠিন পরিস্থিতিতেও সিদ্ধান্ত গ্রহনে সক্ষম হয়। এছাড়া এই ধরণের বাবা-মায়ের সন্তান ভবিষ্যতে সকলের প্রিয় ব্যাক্তিত্ব হয়ে ওঠে। আপনি যদি চান আপনার সন্তান কে সামাজিক ভাবে দক্ষ করে তুলতে, এবং তার মধ্যে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যাক্তিত্ব তৈরি করতে, তাহলে কর্তৃত্বসম্পন্ন পেরেন্টিং স্টাইল ই আপনার জন্য উপযুক্ত।
-
Authoritarian বা স্বৈরাচারী
Authoritarian বা স্বৈরাচারী পেরেন্টিং স্টাইলে প্রথমেই যে কথাটি বলতে হয় তা হল সন্তানের উপর বাবা-মায়ের অত্যধিক কঠোরতা।এক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা তাদের যে কোন মতামতই সন্তানের উপর চাপিয়ে দেন। শিশুর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা বা মন্দ লাগার বিষয়টি তারা একেবারেই গুরুত্ব দিয়ে বিচার করেন না। কেবলই একতরফা নিজেদের সিদ্ধান্ত কে চাপিয়ে দিতে থাকেন।
এই ধরণের পেরেন্টিং স্টাইলে সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে। সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার বোঝাপড়ার বিষয় এখানে গৌণ। কেবলই নিজেদের মতামত চাপানোর দিকে মনযোগী হওয়ার ফলে এই ধরণের পিতামাতা সন্তানের প্রতি যত্নশীল হতে ভুলে যান।
এটি কর্তৃত্বসম্পন্ন পেরেন্টিং স্টাইলের একদম বিপরীত। খেয়াল করে দেখুন আপনার পেরেন্টিং এর সঙ্গে এর কোন মিল পাচ্ছেন না তো ? আপনার অজান্তেই সন্তানের সঙ্গে এই আচরণগুলি আপনিও করে ফেলছেন না তো? তাহলে আজকেই পরিবর্তন করুন আপনার পেরেন্টিং স্টাইল। কেননা গবেষণায় দেখা গেছে স্বৈরাচারী পেরেন্টিং স্টাইলে বড়ো হয়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা অপরাধবোধে ভোগে, তাদের মধ্যে হীনমন্যতাও বেশি কাজ করে। এছাড়া ভবিষ্যতে এদের মধ্যে যে কোন প্রকার নেশার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও খুব বেশি। আপনার সন্তানের ভালোমন্দের কথা বিচার করে আজই আপনার পেরেন্টিং স্টাইল সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠুন।
আরো পড়ুন
-
Permissive বা সহনশীল
সহনশীল পেরেন্টিং স্টাইলে দেখা যায় সন্তানের জন্য পিতামাতা নিয়মনীতি নির্ধারণ করে দিলেও সে সম্পর্কে আর বেশিদিন পর্যন্ত সচেতন থাকছেন না। এই ধরণের পেরেন্টিং স্টাইলে ধারাবাহিকতা খুবই কম এবং সন্তানের প্রতি প্রত্যাশা ন্যুনতম। এক্ষেত্রে অভিভাবক তাদের সন্তানকে সীমাহীন ছাড় দিয়ে ফেলেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোনটি ঠিক এবং কোনটি ভুল সেই বিচারবোধ সন্তানের মধ্যে তৈরি হয় না। শিশুর প্রতি অত্যন্ত কঠোর হওয়া যেমন ঠিক নয়, তেমন ই আপনি যদি সন্তান কে প্রয়োজনের বেশি ছাড় দিয়ে ফেলেন তবে সেটি ও আদর্শ অভিভাবকত্ব হবে না।
আপনার মনে হতেই পারে সন্তান কে একটু স্বাধীনতা দিলে ক্ষতি কোথায়? তাকে নিজের মত বেড়ে উঠতে দিলে সমস্যাই বা কি? সমস্যা এখন অনুভব না করলেও সন্তানের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে কিন্তু তা বেশ সমস্যা তৈরি করতে পারে। আপনার সন্তানের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রন কমে আসতে পারে, সে আবেগতাড়িত, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে পারে।
-
Neglectful বা অমনোযোগী
এই ধরণের পেরেন্টিং স্টাইলে অভিভাবক সন্তানের প্রতি ভীষণভাবে উদাসীন এবং অমনোযোগী। সাধারনত অভিভাবক শারীরিকভাবে অক্ষম হলে বা তার কোন মানসিক সমস্যা থাকলে এই ধরণের পেরেন্টিং স্টাইল দেখা যায়। অথবা পিতামাতাও যদি শৈশবে একইভাবে বেড়ে ওঠে সেক্ষেত্রে অমনোযোগী পেরেন্টিং লক্ষ্য করা যায়। শিশুর প্রাথমিক চাহিদা বা প্রয়োজন কোনটি ই এক্ষেত্রে পূরণ হয় না। সন্তানের প্রতি অভিভাবকের কোন প্রত্যাশা এক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। এছাড়া খুব বেশি স্বাধিনতায় বেড়ে ওঠার ফলে সন্তান বিশৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, নৈতিক মূল্যবোধের অভাব দেখা দেয় এবং পাশাপাশি আচরণগত বহু সমস্যা দেখা দেয়।
মনে রাখবেন আপনার শিশুও একটি মানব সত্ত্বা। অত্যধিক কঠোর বা নমনীয় হওয়া কোনটি ই আপনার সন্তানের ক্ষেত্রে সঠিক নয়। বরং দুইয়ের ব্যালেন্স করে সন্তান কে বড়ো করে তুলুন। আপনার সন্তান ই হয়ে উথবে ভবিষ্যতের সুনাগরিক।
Pingback: আপনার সন্তান কি বারংবার ই বন্ধুদের সঙ্গে লড়াই করে ফেলছে? অভিভাবক হিসাবে কিভাবে আপনি তাকে সহায়তা
Pingback: গুড পেরেন্টিং এর 10 টি নীতি – Parenting